অনুসন্ধানের বিষয় যখন বর্জ্য ও তার বিশ্বজোড়া গন্তব্য

1 year ago 70

English

investigate waste goes world

ইংল্যান্ডের পশ্চিম সাসেক্সে ডকের পাশে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রীর স্তূপ বিদেশে রপ্তানির অপেক্ষায় পড়ে আছে। ছবি: শাটারস্টক

সাধারণ বর্জ্য, পরিত্যক্ত সামগ্রী বা পচনশীল আবর্জনা — যাই বলি না কেন, আমরা যা কিছু ফেলে দিই, তাই সমাজের জন্য একটি বড় সমস্যা। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকেরা বর্জ্যের এই বৈশ্বিক বাণিজ্য তলিয়ে দেখছেন। ড্রোন, ট্র্যাকার ও ডেটাবেস ব্যবহারের মাধ্যমে তারা অনুসন্ধান করছেন, আমাদের ফেলে দেওয়া এই সামগ্রীগুলো কোথায় যাচ্ছে, এবং এগুলোর শেষপর্যন্ত কী গতি হচ্ছে।

২০২২ সালের ওইসিডি রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বব্যাপী দুই দশক আগের তুলনায় দ্বিগুণ প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে, আর এর বেশিরভাগের শেষ পরিণতি হচ্ছে ভাগাড়, দহন বা পরিবেশ দূষণ। কেবল ৯% সফলভাবে পুনর্ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

“কোনো কিছু ফেলে দিলে তা অদৃশ্য হয়ে যায় না।” — অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্ক শ্যাপিরো

যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে প্রতি বছর জনপ্রতি প্রায় ২২১ কিলোগ্রাম, ৫০০ পাউন্ডের সামান্য কম প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় (ওজনের দিক থেকে যা একটি আপরাইট পিয়ানোর সমান), সেখানে ইউরোপে এই পরিমাণ প্রায় ১১৪ কেজি। কেবল জার্মানিতে প্রতি বছর ৩৮০ মিলিয়ন জোড়া জুতা ফেলে দেওয়া হয়, অর্থ্যাৎ, জনপ্রতি প্রায় পাঁচ জোড়া।

এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্টিগেটিভ ফোরাম (ইআইএফ) বোর্ডের সদস্য পুরস্কারজয়ী মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্ক শ্যাপিরো বলেছেন, আমাদের আবর্জনা কোথায় যায় এবং মানুষ ও পরিবেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধান সচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এক্সপোস্ড: দ্য টক্সিক কেমিস্ট্রি অব এভরিডে প্রোডাক্টস অ্যান্ড হোয়াটস অ্যাট স্টেক ফর আমেরিকান পাওয়ার” বইয়ের লেখক শ্যাপিরো বলেন, “কোনো কিছু ফেলে দিলে তা অদৃশ্য হয়ে যায় না। বর্জ্য থেকে যে হুমকি তৈরি হয় তা জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্জ্যের বিষাক্ত উপাদান পানির সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটিও গভীর বৈষম্যের আরেকটি মাত্রা সামনে আনে।”

আবর্জনার গতিপথ অনুসরণে ট্র্যাকারের ব্যবহার

২০২২ সালে ইউরোপীয় প্রেস পুরষ্কার-মনোনীত স্টোরি “স্নিকারজ্যাগড” বা স্নিকারহান্ট অনুসন্ধানে পরিত্যক্ত জুতার পরিণতি নিয়ে অনুসন্ধান করেন একদল জার্মান সাংবাদিক। তারা দেখিয়েছেন যে রিসাইক্লিং হয়তো গ্রাহকদের বিবেকবোধকে শান্ত করতে পারে, তবে এটি আবর্জনা সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নয়।

এই প্রকল্পে কর্মরত সাংবাদিক ক্রিশ্চিয়ান সালেউস্কি ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকাশনা ফ্লিপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফেলিক্স রোরবেক ইলেকট্রনিক বর্জ্যের অবৈধ রপ্তানি অনুসন্ধানে জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করেছেন, আর ফাস্ট ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি (স্বল্পমূল্যের পোশাক) নিয়ে অনুসন্ধানে একই পদ্ধতি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

investigating garbage sneakerjagd rubbish recycling

জার্মান অনুসন্ধানী সাইট ফ্লিপ জার্মান সেলিব্রিটিদের দেওয়া জুতাগুলোতে জিপিএস ট্র্যাকার বসিয়েছে আর তারপর সারা বিশ্বে জুতাগুলোর যাত্রাপথ অনুসরণ করেছে৷ ছবি: স্ক্রিনশট, ফ্লিপ

তারা বিষয় হিসেবে জুতা বেছে নিয়েছেন, কারণ এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জোড়া লাগানো ঢালাই করা প্লাস্টিকের স্তরের কারণে সেগুলো রিসাইকেল করা কঠিন হয়ে যায় এবং জুতার ভেতরের সুকতলাগুলোর কারণে ট্র্যাকার লুকানোর সুবিধাজনক জায়গা পাওয়া যায়।

সালেউস্কি বলেন, “আমরা মাথায় একটা চিন্তা আসে, আমরা কেন সেলিব্রিটিদের জুতা ব্যবহার করি না? আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিলাম আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় মোটামুটি অনাগ্রহী সোশ্যাল মিডিয়া অনুসরণকারীদের ব্যবহার করে বিভিন্ন চ্যানেলে স্টোরিটি প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। আমরা অনলাইনে তুলনামূলক তরুণ, জুতা ক্রেতাদের নিজেদের টাইমলাইনে সমস্যাটি চিহ্নিত করে তাদেরকে টার্গেট বানাতে চেয়েছিলাম।”

রিপোর্টারেরা সেলিব্রিটিদের ব্যবহৃত জুতা দানের সেলফি-ভিডিও ধারণের আয়োজন করেছিলেন। জুতাগুলো পরবর্তীতে খুচরা বিক্রেতা, জুতার ব্র্যান্ড, অলাভজনক বা টেক্সটাইল রিসাইকেল কোম্পানিগুলোর সরবরাহকৃত রিসাইক্লিং ঝুড়িতে রাখা হয়েছিল। ভেতরে লুকানো ছিল জিপিএস প্রযুক্তি (যা অবস্থান শনাক্ত করতে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে), জিএসএম অ্যান্টেনা (ওয়্যারলেস ট্রান্সমিশন সিস্টেম যা মোবাইল ফোনের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে), আর স্লিপ মোডে ব্যাটারি সংরক্ষণের জন্য মুভমেন্ট ডিটেক্টর। এগুলো কেবল নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং লম্বা সময় ধরে যোগাযোগ করার মতো করে প্রোগ্রাম করা ছিল – যেমন, যথেষ্ট নড়াচড়ার পর ট্র্যাকারটি যোগাযোগ শুরু করত

“ইন্ডাস্ট্রি ও সরকারের ভাষ্য, ‘আপনার আবর্জনা আপনাকেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে হবে, আপনাকে দায়িত্ব সচেতন হতে হবে।’ তারা ইন্ডাস্ট্রির ওপর দায় না দিয়ে বরং ভোক্তাদের দোষ দেয়।” — ওহো পুবলিকোর সাংবাদিক কেনিয়া ভেলাজকুয়েজ

এনডিআর ও জেইট নামের দুটি গণমাধ্যমের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে দলটি। বিভিন্ন পর্বে প্রতি জোড়া জুতার গল্প তুলে ধরতে তারা একটি এপিআই ইন্টারফেস ব্যবহার করেন। ট্র্যাকার থেকে প্রাথমিক ডেটাকে তথ্যপূর্ণ ভিজ্যুয়াল ভ্রমণে রূপ দিতে, তারা একটি ডেটা দলের সঙ্গে মিলে প্রেক্ষাপট অনুসারে ট্র্যাকার পিং-এ মানচিত্র, ছবি, ভিডিও, ও টেক্সট বসিয়ে একটি ইন্টারেক্টিভ ওয়েবসাইট তৈরি করেন।

তারা জুতাগুলোর অগ্রগতি ট্র্যাক করে নিজেরাই ভিডিও ধারণ করেছেন আর কিছু ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে কী ঘটছে, তা দেখতে স্থানান্তরের জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করেছেন।

সালেউস্কি বলেন, “কোনো জিনিস একবার ফেলে দেওয়ার পর শেষ পরিণতি কী হয়, তা অনুসন্ধানে জিপিএস অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার ; জিপিএস ব্যবহার করে ডেটা পাওয়া যায়, যা আপনি একটি মানচিত্রে দেখাতে পারেন ৷ ট্র্যাকিং সবসময় আমাদের টুলবক্সে থাকে। প্রযুক্তি সম্পর্কে আপনার তেমন জানাশোনা না থাকলেও চলে; তবে বিষয়টি মজার – এটি উত্তেজনাপূর্ণ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়: প্রতিবেদক হিসেবে আমাকে অনুসরণ করুন, আমি জানি না কী হবে।”

এই কৌশলে ভালো ফল এসেছে। অনুসন্ধানের সবচেয়ে বড় স্কুপগুলোর একটিতে দলটি আবিষ্কার করেছে যে নতুন নাইকি জুতা রিসাইকেল না করে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছিল।

আর টিভি উপস্থাপক লিন্ডা জারভার্কিসের একজোড়া সাদা পুমা ট্র্যাক করে তাঁরা কেনিয়ার নাইরোবিতে পৌঁছে যান, যেখানে আফ্রিকায় টেক্সটাইল আমদানি ও সেগুলো থেকে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে আরও জানতে সাংবাদিকেরা অবাঞ্ছিত পুরনো কাপড়ে বোঝাই পরিবেশগতভাবে ক্ষতিকর বড় বড় ভাগাড়সহ অন্যান্য স্থান ভ্রমণ করেছেন।

সালেউস্কি বলেন, প্রায় এক কোটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে স্নিকারজ্যাগড অনুসন্ধানটি এবং এটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে; তাগেসচাউ সহ সমাদৃত টিভি অনুষ্ঠানগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার ছাপিয়ে এর পরিচিতি আরও ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে৷

শ্যাপিরো বলেন, “বর্জ্যসৃষ্ট দূষণের গতিপথ শনাক্তে এই স্টোরিগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে এটি বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। আপনার বাড়ি বা কর্মস্থল থেকে যখন বর্জ্য বেরিয়ে আসে, তখন তা হাওয়া মিলিয়ে যায় না। উৎপাদকদের দায় নির্দেশ করাও এই অনুসন্ধানগুলোর একটি দিক – অনেক সময় অনেক কম বিষাক্ত বিকল্প পাওয়া যায়।”

সংখ্যাকে প্রশ্ন করুন

পেরুতে বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার। ছবি: মার্কো গ্যারো / ওহো পুবলিকো

ওহো পুবলিকোর সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের ভিত্তি ছিল, প্রথমে তন্নতন্ন করে ডেটা খোঁজা — এরপর মাঠপর্যায়ে রিপোর্টিং। এভাবেই ২০২২ সালের নভেম্বরে ল্যাটিন আমেরিকা: দ্য রিপোজিটরি ফর আদার পিপলস্ গারবেজ প্রকাশিত হয়েছিল৷ সেই স্টোরিটি এই অঞ্চলে বড় বড় পরিবেশগত ও প্লাস্টিক বর্জ্য রপ্তানির কারণে সৃষ্ট নৈতিক সমস্যা তুলে ধরেছে।

জিআইজেএনের সদস্য প্রতিষ্ঠান সংবাদমাধ্যমটির সাংবাদিকদের চোখে পড়েছে যে পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়াটিই সমস্যা জর্জরিত এবং সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিতে মোটেও স্বচ্ছতা নেই।

এই অনুসন্ধানের অনুপ্রেরণা কী ছিল? “একটি ছোট্ট রিপোর্ট, যেখানে বলা হয়েছে, লাতিন আমেরিকা ছিল গোটা বিশ্বের ভাগাড়,” কথাগুলো বলেছেন ওহো পুবলিকোর সাংবাদিক কেনিয়া ভেলাজকুয়েজ, যিনি এই স্টোরিতে মনিকা সার্বন ও অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করেছেন৷

প্লাস্টিকের আবর্জনার চালান শনাক্তে শিপিং ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহকারী একটি ডেটা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সমস্যাটি অনুসন্ধানে মেক্সিকো ও পেরুর সাংবাদিকেরা জোট বেঁধেছেন।

সরকারগুলো যেভাবে মানুষের সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে প্লাস্টিক বর্জ্য ও পুনর্ব্যবহারকে সামনে আনে, তা তাদের প্রচেষ্টার পালে হাওয়া দিয়েছে। ভেলাজকুয়েজ বলেন, “প্লাস্টিক দিয়ে আমরা কী করি, তা নিয়ে একটি বড় আলোচনা রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি ও সরকারের ভাষ্য, ‘আপনার আবর্জনা আপনাকেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে হবে, আপনাকে দায়িত্ব সচেতন হতে হবে।” তারা ইন্ডাস্ট্রির ওপর দায় না দিয়ে বরং ভোক্তাদের দোষ দেয়। এই অনুসন্ধান নিয়ে আমি যখন ভাবতে শুরু করি, তখন আমার চারপাশে আমার বাড়িতে, সুপার মার্কেটে, সর্বত্র প্লাস্টিক দেখেছি। আমরা এর গভীরতা দেখতে চেয়েছিলাম।”

ব্যবহৃত ব্যাটারি, দূষিত পানি ও রাসায়নিক পণ্যের মতো অন্যান্য চালান থেকে প্লাস্টিক বর্জ্যকে আলাদা করে লাতিন আমেরিকায় আসা আবর্জনার কন্টেইনার প্রকাশ্যে আনার মতো ডেটা খুঁজে বেড়িয়েছে দলটি।

ভেলাজকুয়েজ বলেন, “আমরা বুঝতে পারি যে সমস্যাটি আমাদের ধারণার চেয়েও বড়। কেবল মেক্সিকোতে আমরা অর্ধলক্ষ চালান খুঁজে পেয়েছি।”

ধারণা করা হয়, লাভজনক ব্যবসায়িক ধারায় বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে দিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে অন্যান্য দেশগুলো লাতিন আমেরিকায় বর্জ্য পাঠায়। সাংবাদিকেরা লক্ষ্য করেছেন যে অনেক সময় আবর্জনাগুলো রিসাইক্লিং করার জন্য প্রস্তুত থাকে না, দূষণ ছড়ানো রাসায়নিক ও পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়, বা শেষ পর্যন্ত ভাগাড়ে ফেলা হয়, যার ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিক দিয়ে চারপাশের পরিবেশ দূষিত হয়। পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি কোম্পানি পরিবেশগত নিয়মনীতি মেনে চলেনি।

শ্যাপিরো বলেন, “বিষাক্ত উপাদানসহ পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো যে তাদের পণ্যের পচা অংশ নিয়ে কোনো চাপের মুখে থাকে না, তা যেভাবে সুস্পষ্টভাবে বা ইঙ্গিপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়, সেটিই বর্জ্য রপ্তানি উন্মোচনকারী এই স্টোরিগুলোর একটি মজার দিক।”

এক্সেল ব্যবহার করে, প্রতিটি কন্টেইনারের বিবরণীর প্রতিটি লাইন পরীক্ষা করে ওহো পুবলিকো হাতে কলমে এই বিশ্লেষণ করেছে, কারণ প্রতিটি কন্টেইনারের বিবরণ ছিল ভিন্ন আর প্রক্রিয়াটিকে স্বয়ংক্রিয় করতে গিয়ে মূল্যবান তথ্য হারিয়ে যেতে পারত।

সাংবাদিকেরা তখন পরিবহনের জন্য দায়িত্বরত কোম্পানি ও সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তারা কেবল একটাই উত্তর পেয়েছেন। ভেলাজকুয়েজ বলেছেন, “অনেক অস্বচ্ছতা আমাদের চোখে পড়েছে। অনেক সরকারের কাছে আমরা চিঠি পাঠিয়েছি, তারা কোনো জবাব দেয়নি। কেবল একটি কোম্পানি সাড়া দিয়েছিল আর বলেছিল যে সব কিছু ঠিকই আছে। দেশগুলোতে কোনো সরকারি ডেটা পাওয়া যায়নি, তাই আমরা এই প্ল্যাটফর্মে হাজির হয়েছি।”

সমস্যার মাত্রা তুলে ধরতে এবং বড় বড় সংখ্যাগুলো পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য করে তুলতে দলটি একেকটি স্থান জুম ইন করে দেখতে চেয়েছে।

এখানে ছবির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং দলটির আলোকচিত্রীরা এমনকি মেক্সিকোতে একটি পৌরসভার ভাগাড়ের ছবি তুলতে ছদ্মবেশ ধরেছিলেন, যেখানে ড্রোন থেকে তোলা ছবিগুলোও আবর্জনা পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরতে সহায়তা করেছিল। “আমি যে বিষয়গুলো তুলে ধরতে চেয়েছিলাম, তার একটি হলো আমাদের এত বর্জ্য থাকার পরও কেন আমরা বর্জ্য আমদানি করছি?” ভেলাজকুয়েজ প্রশ্ন রেখেছেন।

বৈশ্বিক সমস্যা

ব্যাগে সাজানো পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বোতল। ছবি: হুয়ান হোসে এল. প্লাসেনসিয়া / ওহো পাবলিকো

বিশ্বের অনেক অঞ্চলে করোনভাইরাস মহামারির ফলে মাত্র একবার ব্যবহারযোগ্য (সিঙ্গেল ইউজ) প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে গেছে, আর ব্যবহৃত প্লাস্টিক নিয়ে কী করা যায় সেই প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে এসেছে। ইউরোপের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, স্নিকারজ্যাগডের পর দুই বছরে বর্জ্য নিয়ে ইউরোপের সমস্যা মোটেও মেটেনি।

প্লাস্টিক বর্জ্যসৃষ্ট সমস্যাজর্জরিত সব খাত আলোকিত করার লক্ষ্যে ডেটা-চালিত পদ্ধতি ব্যবহার করে ইনভেস্টিগেট ইউরোপ গত মাসে ওয়েস্টল্যান্ড — ইউরোপস্ প্লাস্টিক ডিজাস্টার শীর্ষক স্টোরিতে এ অঞ্চলের প্লাস্টিক সমস্যা নিয়ে একটি বড় মাপের অনুসন্ধান তুলে ধরেছে।

অনুসন্ধানটি আবর্জনা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট দূষণ ও বর্জ্য নিয়ে অবৈধ ব্যবসার মতো বিষয়গুলো তুলে ধরে এবং ইউরোপের সার্কুলার ইকোনোমির ঘাটতিগুলো প্রকাশ্যে আনে।

“প্রচুর ডেটা ক্রাঞ্চিং (বিপুল পরিমাণ প্রাথমিক ডেটার স্বয়ংক্রিয় বিশ্লেষণ) থাকলেও আমরা স্প্রেডশিট, এক্সেল, ইত্যাদির মতো সহজ কৌশলগুলো ব্যবহার করেছি,” ব্যাখ্যা করে বলেন ওয়েস্টল্যান্ড ইনভেস্টিগেশনের প্রধান গবেষক নিকো শ্মিট৷

ওহো পুবলিকোর রিপোর্টারদের কল্যাণে, সমন্বিত এই ডেটা স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা সামনে এনেছে। শ্মিট বলেন, “ডেটা প্রথমে আসলেও তারপরই আসে স্টোরি, তাই আপনি বিচিত্র বিষয়গুলোর খোঁজ করেন, ডেটা নিয়ে প্রশ্ন করেন এবং পরিশেষে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন। বর্জ্য নিয়ে আপনার কাছে বিভিন্ন ধরনের অনেক ডেটা সোর্স রয়েছে আর অবশ্যই আপনাকে দেখতে হবে যে কোথা থেকে ডেটা আসছে, প্রকৃতপক্ষে কে যোগান দিচ্ছে।”

তিনি নির্দিষ্ট করে বলেন, অনেক সময় প্লাস্টিক উৎপাদকদের ডেটাই অনেকটা অফিসিয়াল ডেটা হিসেবে তুলে ধরা হয়। “বিভিন্ন ডেটা সোর্সগুলোর তুলনা আর এমনকি একেবারেই মৌলিক নীতিমালা বোঝাপড়ায় অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল, কারণ কখনও কখনও বিষয়গুলো কেবল ফুটনোটের আড়ালে পড়ে যায়।”

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধান

নোংরা পোশাক — এসভিটি (সুইডেন)

সংগঠিত অপরাধচক্র কীভাবে দাতব্য সংস্থার কালেকশন বাক্স থেকে পোশাক চুরি করে মিলিয়ন ইউরো হাতিয়ে নেয়, তা উন্মোচন করেছে সুইডেনের সরকারি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান এসভিটির অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান মিশন ইনভেস্টিগেট। এই কাজে তারা আন্তর্জাতিক সহকর্মীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে। ২০২১ সালের এই তথ্যচিত্রে একাধিক দেশে বিস্তৃত একটি আন্তর্জাতিক চক্রকে ধরতে জিপিএস ট্র্যাকার, গোপন ক্যামেরা, ড্রোন ও মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে।

ডাও বলেছে, তারা আমাদের জুতা রিসাইকেল করছে। আমরা সেগুলো পেয়েছি ইন্দোনেশিয়ার খোলা বাজারে – রয়টার্স (সিঙ্গাপুর)

রয়টার্সের সাম্প্রতিক এই বিশেষ প্রতিবেদনে বড় পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি ডাও-এর দাবিগুলো খতিয়ে দেখা হয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, পুরনো, অনুদানের জুতাগুলোকে খেলার মাঠের সরঞ্জাম ও ছোট দেশের রানিং ট্র্যাকে জায়গা করে দিতে তারা সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। তবে জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করে রয়টার্স দেখতে পায়: অনুদান হিসেবে দেওয়া ১১ জোড়া জুতার মধ্যে ১০টি জোড়াই মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে গেছে এবং সেগুলো শেষ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দলটি শেষ অবধি তাদের লক্ষ্যবস্তু তিন জোড়া জুতার খোঁজ করে, যেগুলোর শেষ গন্তব্য ছিল পুরনো জুতার বাজার। এই জুতাগুলোর কোনোটাই কর্পোরেশনের দাবিকৃত রিসাইক্লিং পথ অনুসরণ করেনি।

বর্জ্যের গতিপথ অনুসরণ করুন – ওস্ট্রো (স্লোভেনিয়া)

২০২২ সালে এই স্লোভেনীয় অনুসন্ধানী সাইটটি একটি উচ্চাভিলাষী ধারাবাহিকের কাজে হাত দেয় যা ভোক্তার ধরন ভেদে সেই দেশের বর্জ্যের ভবিষ্যৎ গন্তব্য খতিয়ে দেখে। বর্জ্যের গতিবিধির ওপর নিবিড় নজর রাখতে দলটি প্লাস্টিকের বোতল, টিভি, কম্পিউটার, শিশুর পুতুল, পিঠের ব্যাগ ও ভ্যাকুয়াম ক্লিনার সহ ৩০টি সাধারণ গৃহস্থালী পণ্যে ট্র্যাকার জুড়ে দেয়৷ তারা দেখতে পায়, অনেকগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য বস্তু নিয়মিত বর্জ্যের স্রোতে মিশে গেছে এবং অন্যান্য সামগ্রীর ঠাঁই হয়েছে ক্রোয়েশিয়া ও পাকিস্তানে৷ ওস্ট্রো তাদের এই অনুসন্ধানের পদ্ধতি নিয়ে একটি লেখাও প্রকাশ করেছে এবং এ ধরনের অনুসন্ধানের পুনরাবৃত্তি করতে আগ্রহীদের পরামর্শ দিয়েছে।

বর্জ্য্ বাছাই কেন্দ্রগুলোতেই এক তৃতীয়াংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য হারিয়ে যায় — মেট্রোপোলস (ব্রাজিল)

রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান অবৈধভাবে ডাম্পিংয়ে একটি বর্জ্য কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা ধরা পড়ার ঘটনা থেকে এই রিপোর্টিং প্রকল্প শুরু হয়। এটি কোনো একক ঘটনা বা পদ্ধতিগত সমস্যার ইঙ্গিত কিনা তা বুঝতে ব্রাজিলের অনলাইন সাইটটি সাধারণ পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদানগুলোর সঙ্গে পাঁচ ডজনেরও বেশি ট্র্যাকার জুড়ে দেয় এবং এক মাস ধরে সেগুলোর গতিবিধি অনুসরণ করে৷ তারা আবিষ্কার করেন যে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিসগুলো প্রায়ই ভুল পথে চলে যায় বা সাধারণ আবর্জনার সঙ্গে মিশে যায় এবং শেষমেষ সেগুলোর জায়গা হয় ভাগাড়ে। এই স্টোরির ফলে বেশ কয়েকটি বর্জ্য কোম্পানি ও একটি পৌর সংস্থা সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চালানোর অঙ্গীকার করে। বর্জ্য নিয়ে জবাবদিহিমূলক প্রতিবেদন তৈরিতে রিমোট ট্র্যাকারের আধুনিক ব্যবহারের জন্য মেট্রোপোলস ২০২২ সালের সিগমা অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে।

অবাঞ্চিত কাপড়ের শেষ গন্তব্য কোথায়, তা নিয়ে অনুসন্ধানে ট্র্যাকারের ব্যবহার – ইয়েল (ফিনল্যান্ড)

২০২০ ও ২০২১ সালে প্রকাশিত ফিনল্যান্ডের এই স্টোরিগুলো আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশটির সরকারি টিভি ইয়েলের সাংবাদিকেরা শোচনীয় অবস্থাপন্ন ব্যবহৃত পোশাকে ছয়টি ছোট ট্র্যাকার লুকিয়ে দান বাক্স ও ড্রপ-অফ বাক্সে রেখেছিলেন। সেখান থেকে হাই স্ট্রিট ফ্যাশন চেইনগুলো ব্যবহৃত ও অবাঞ্ছিত পোশাক সংগ্রহ করে। দাতব্য সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে খারাপ কাপড় রপ্তানি না করার দাবি করা হলেও দলটি লাটভিয়া, পাকিস্তান ও আফ্রিকায় সেগুলো খুঁজে পেয়েছে – যেখানে সেগুলোকে “সাদা মানুষের পোশাক” বলা হয়।

আরও পড়ুন

সরবরাহ চেইন অনুসন্ধানের যত রকম কৌশল

রাশিয়ার রোমান আনিন তার অনুসন্ধানে যেসব টুল ব্যবহার করেন

ট্র্যাকিং দ্য ইললিগাল ট্রেড ইন আর্টিফ্যাক্টস


হেলেন ম্যাসি-বেরেসফোর্ড ফ্রান্সের প্যারিস ভিত্তিক একজন রিপোর্টার ও সম্পাদক। তিনি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ব্যবসা, টেকসইত্ব, বিমান চালনা, বিজ্ঞান ও খাদ্য নিয়ে কাজ করেন।

The post অনুসন্ধানের বিষয় যখন বর্জ্য ও তার বিশ্বজোড়া গন্তব্য appeared first on Global Investigative Journalism Network.

Read Entire Article