ফোন ডেটা সংগ্রহের ফরেনসিক টুল যখন সাংবাদিক নিপীড়নের নতুন ক্ষেত্র  

1 year ago 142

English

ছবি: শাটারস্টক

রাশিয়ার খাকাসিয়া প্রজাতন্ত্রের পুলিশ, গত ১৩ই এপ্রিল, অনলাইন সাময়িকী নভি ফোকাসের প্রধান সম্পাদক মিখাইল আফানাসিয়েভকে গ্রেপ্তার এবং তাঁর ডিজিটাল ডিভাইসগুলো জব্দ করে। দক্ষিণ সাইবেরিয়ার দাঙ্গা পুলিশ ইউক্রেনে কাজ করতে  অস্বীকৃতি জানিয়েছে মর্মে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করার জেরে আফানাসিয়েভকে আটক করা হয়। “মিথ্যা” তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে তিনি এখন সম্ভাব্য ১০ বছর কারাদণ্ডের মুখোমুখি।

কোনো সাংবাদিকের ব্যাপারে তদন্তে নেমে ফোন ও কম্পিউটার জব্দ করা সরকারের জন্য মোটেও নতুন কিছু নয় – বরং, এটি একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের পহেলা ডিসেম্বর, সিপিজের জেল শুমারিতে কারাবন্দী সাংবাদিকদের একটি খণ্ডচিত্র উঠে আসে। এতে ইরান, বেলারুশ, আজারবাইজান, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, ভারত ও রাশিয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়।

স্পাইওয়্যারের মতো ফরেনসিক টুলগুলোও ফোন বা কম্পিউটারের সব কিছুতে অ্যাক্সেস করতে পারে। মূল পার্থক্য হলো স্পাইওয়্যার অতটা সহজলভ্য নয়, কিন্তু ফরেনসিক টুলগুলো  – নিপীড়নমূলক বা গণতান্ত্রিক দেশ – নির্বিচারে সবখানেই ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়।

স্পাইওয়্যারের মতো ফরেনসিক টুলগুলোও ফোন বা কম্পিউটারের সব কিছুতে অ্যাক্সেস করতে পারে। মূল পার্থক্য হলো স্পাইওয়্যার অতটা সহজলভ্য নয়, কিন্তু ফরেনসিক টুলগুলো  – নিপীড়নমূলক বা গণতান্ত্রিক দেশ – নির্বিচারে সবখানেই ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়।

ডিভাইস জব্দের পর কী হয়, তা খুব একটা জানা যায় না। যেমন; আফানাসিয়েভের ডিভাইসগুলো নিয়ে রুশ কর্তৃপক্ষ কী করেছে, আমরা জানি না। কিন্তু আমরা জানি, মিয়ানমারে সাংবাদিকদের দোষী সাব্যস্ত করতে এবং নাইজেরিয়ায় সোর্সের খোঁজ পেতে তাঁদের ফোন পরীক্ষার জন্য সহজলভ্য ফরেনসিক টুল ব্যবহার করা হয়েছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য যখন কোনো সাংবাদিকের আনলক করা ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করেন, নিঃসন্দেহে তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে এই ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে। অনেক সময় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে লক করা ফোন ও কম্পিউটারের সব কন্টেন্টও কপি এবং তল্লাশী করা যায়ফরেনসিক টুলগুলো অনেকটা স্পাইওয়্যারের মতোই কাজ করে। এগুলো ফোন বা কম্পিউটারের সবকিছুতে অ্যাক্সেস করতে পারে। মূল পার্থক্য হল স্পাইওয়্যার অতটা সহজলভ্য নয়, কিন্তু ফরেনসিক টুলগুলো  – নিপীড়নমূলক বা গণতান্ত্রিক দেশ – নির্বিচারে সবখানেই ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। এগুলোর ব্যবহার সংবাদমাধ্যমের প্রতি হুমকি যতটা ত্বরান্বিত করেছে, সুরক্ষা ও জনসচেতনতা ততটা বাড়েনি।

তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যানফোর্ড ইন্টারনেট অবজারভেটরির রিসার্চ স্কলার রিয়ানা ফেফারকর্ন ইমেইলে জানান, “মোবাইল ফোনের ফরেনসিক টুল দিয়ে মুছে ফেলা ডেটা, এমনকি স্ক্রল করার সময় খালি চোখে দেখা যায় না, এমন অনেক ডেটা পুনরুদ্ধার করা যায়।”

যুক্তরাষ্ট্রঅস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর সরকারি সংস্থায় ব্যাপক হারে এই টুলগুলোর ব্যবহার হচ্ছে — আর এমন অনেক দেশে এগুলো নথিভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে হুমকি হিসেবে গণ্য করেন৷ ২০২০ সালে রাশিয়ার তদন্ত কমিটির প্রধান বলেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গত বছর ইসরায়েল-ভিত্তিক কোম্পানি সেলব্রাইটের ডেটা এক্সট্রাকশন টুল ব্যবহার করে সেলফোনে ২৬,০০০ বার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে। মানবাধিকারের উদ্বেগের বিষয়টি উল্লেখ করে সেলব্রাইট ২০২১ সালে রাশিয়া ও বেলারুশের কাছে এই টুল বিক্রি বন্ধের কথা জানিয়েছে। তবে ইসরায়েলি পত্রিকা হারেজের ভাষ্যমতে, ২০২২ সালে রুশ তদন্ত-সংস্থাগুলো সরকারি প্রতিবেদন ও প্রশিক্ষণ সামগ্রীতে দেশটির এসব পণ্যের কথা ক্রমাগত উল্লেখ করে গেছে।

Cellebrite marketing screenshot

ইসরায়েল-ভিত্তিক কোম্পানি সেলব্রাইট বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোর কাছে ডিজিটাল তদন্ত সহায়ক হিসেবে নিজেদের পণ্য বাজারজাত করে। ছবি: স্ক্রিনশট, সেলব্রাইট

সেলব্রাইট নিজস্ব ওয়েবসাইটে তাদের সেবা সম্পর্কে বলেছে যে এটি অপরাধীদের ধরতে সাহায্য করার জন্য বানানো হয়েছে। তাদের মতে, এটি “১৪০টিরও বেশি দেশে ৬,৭০০ টিরও বেশি রাষ্ট্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় জননিরাপত্তা সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে বিশ্বস্ত” এবং বাজারের সবচেয়ে সুপরিচিত টুল। এই টুল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে কম্পিউটার ফরেনসিক প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকব্যাগ টেকনোলজিস ক্রয় করেছে। ২০১৯ সালে গবেষক ভ্যালেন্টিন ওয়েবার মার্কিন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওপেন টেকনোলজি ফান্ডে লিখেছেন, চীনা কর্মকর্তারা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপজুড়ে বন্দর ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে বাণিজ্যের প্রচারের স্বার্থে ট্রিলিয়ন-ডলারের প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে ডিজিটাল ফরেনসিক প্রশিক্ষণ দিতে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেইয়া পিকোকে দিক নির্দেশনা দিয়েছে

ফরেনসিক পণ্যগুলো পেগাসাসের মতো জিরো-ক্লিক স্পাইওয়্যার থেকে আলাদা, সম্প্রতি যাকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য অস্তিত্বের হুমকি বলে অভিহিত করেছে সিপিজে। কারণ, এগুলো ব্যবহার করে রাষ্ট্র গোপনে ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে সাংবাদিক ও তাঁদের সোর্সদের ফোন হ্যাক ও ট্র্যাক করতে পারে৷ স্পাইওয়্যার দূর থেকে অদৃশ্যভাবে ডিজিটাল ডিভাইসে ঢুকতে পারে, যা সহজেই অস্বীকার করা যায়, আর বেশ ব্যয়বহুলও বটে

অন্যদিকে, ফরেনসিক টুল ব্যবহারের জন্য ডিভাইসটিকে হাতে পেতে হয়। পুলিশ স্টেশন বা চেকপয়েন্টে চাপের মুখে নিজেদের ডিভাইসগুলো জমা দিতে বাধ্য হলেও এক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা অন্তত জানেন যে  তাঁদের ফোন ও পাসকোড বেহাত হয়েছে।

কিন্তু কোনো ল্যাব বা থানায়, ফোন থেকে সংগ্রহ করা ডেটা সেই ফোনের মালিকের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা যায়।

ফেফারকর্ন বলেছেন, “পুলিশের ব্যবহৃত টুলগুলো ফরেনসিক উপায়ে যথাযথভাবে কন্টেন্ট এক্সট্রাক্ট ও সংরক্ষণের উপযোগী করে বানানো হয়েছে, যেন আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা যায়।”

আইনি সুরক্ষার কাঠামো এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি। ওয়াশিংটন পোস্টের ভাষ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন (সিবিপি)-এর সদস্যরা কোনো সমন ছাড়াই ভ্রমণকারীদের ডিভাইস থেকে সংগ্রহ করা ডেটার একটি ডেটাবেসে প্রবেশ করতে পারে। সাংবাদিকেরা সিপিজেকে জানিয়েছেন, তাঁরা ঐ দেশে প্রবেশের পর সিবিপি কর্মকর্তারা তাঁদেরকে ইলেকট্রনিক সার্চে বাধা দিয়েছে।

“আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো নির্দিষ্ট তল্লাশীতে কী প্রাসঙ্গিক হবে, তা সচেতনভাবে আলাদা করা সম্ভব নয় বলে… এই টুলগুলো একেবারেই ব্যবহার না করার পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে।” — স্টিভেন ফেল্ডস্টেইন, কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস

কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন বিচারব্যবস্থা আনরিপোর্টেড সোর্স ম্যাটেরিয়াল জব্দ হওয়া থেকে সুরক্ষা দিলেও পুলিশের হাত ঠিকই সেখানে চলে যায়। ২০১৯ সালে ফ্রিল্যান্সার ব্রায়ান কারমোডি সিপিজেকে জানিয়েছেন, তাঁর ও তাঁর বাগদত্তার ডিভাইসগুলো জব্দ করার পর সান ফ্রান্সিসকো পুলিশ তাঁর ট্যাবলেটটি ফিরিয়ে দিয়েছিল, আর সেটির স্ক্রিনে একটি নোটে পাসকোড লাগানো ছিল। তাঁর আইনজীবীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পুলিশ ডিভাইসগুলো সার্চ করে পাওয়া তথ্য মুছে ফেলতে রাজি হয়।

সিপিজের জেল শুমারিতে দেখা যায়, অন্যান্য ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা অনেক সময় এ ধরনের সুবিধাও পান না। সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্য, জীবিকার জন্য ফোনের ওপর নির্ভরশীল ফ্রিল্যান্সার, বা যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষ, যাদের কাছে এই ডিভাইসগুলোই যোগাযোগের একমাত্র উপায় – তাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দের অজস্র নজির রয়েছে এই গবেষণায়। একবার মুক্তি পেলেও সাংবাদিকেরা ভয়ে থাকেন যে তাঁদের ডিভাইসে স্পাইওয়্যার দেয়া হয়েছে, আর তাঁদের সব কিছু আবারো পুলিশের হাতে চলে যাবে। এই ভয়ে তারা ডিভাইস ব্যবহারে বিরত থাকেন। কারাগারে থাকলে সাংবাদিকেরা ঝুঁকিতে থাকেন যে ডিভাইস থেকে পাওয়া তথ্য জিজ্ঞাসাবাদের সময় ও বিশেষ ফৌজদারি মামলা সাজাতে ব্যবহৃত হতে পারে।

ডিজিটাল ফরেনসিক ব্যবহার করে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো লক্ষ্যবস্তু হওয়া ব্যক্তির ফোন থেকে প্রচুর ডেটা হাতিয়ে নিতে পারে। তাই ডিজিটাল অবসাদ নিয়ে গবেষণারত কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো স্টিভেন ফেল্ডস্টেইন, স্পাইওয়্যার ও ফরেনসিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল দেখতে পান এবং টুল দুটির ব্যবহারের পর্যালোচনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সংস্কারের সমান প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

তিনি বলেছেন, “আমার মনে হয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পেয়েছে, তবে তা যতটা বাস্তব তার চেয়েও বেশি কৃত্রিম বলে আমার সন্দেহ হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো নির্দিষ্ট তল্লাশীতে কী প্রাসঙ্গিক হবে, তা সচেতনভাবে আলাদা করা সম্ভব নয় বলে… এই টুলগুলো একেবারেই ব্যবহার না করার পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে।”

এই দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্ব না পাওয়া পর্যন্ত সরকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে তাঁদের নিজেদের ফোন ব্যবহার করতে ফরেনসিক টুল কাজে লাগাতে পারে। রাশিয়ার আফানাসিয়েভের মতো যেসব সাংবাদিকদের ডিভাইস জব্দ হয়েছে, তাঁরা আরও বেশি দুর্বল সেই সব আইনের সামনে যা সাংবাদিকতাকে অপরাধের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে।

এই পোস্ট প্রথম প্রকাশিত হয় কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)-এর ওয়েবসাইটেঅনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

আরও পড়ুন

ডিজিটাল নিরাপত্তা: সাংবাদিকদের যা যা জানা দরকার

মেটাডেটা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার উপায়

হাও ডেটা জার্নালিস্টস ক্যান ইউজ অ্যানোনিমাইজ টু প্রোটেক্ট প্রাইভেসি


ম্যাডেলিন আর্প, সিপিজে-র প্রযুক্তি বিষয়ক পরামর্শক সম্পাদক। ফ্রিডম হাউজের ফ্রিডম অন দ্য নেট প্রতিবেদনের ডিজিটাল নিরাপত্তা ও অধিকার বিষয়ক গবেষণা তিনি সম্পাদনা করেছেন পাঁচটি সংস্করণে। এর আগে কাজ করেছেন সিপিজে-র এশিয়া বিষয়ক গবেষক হিসেবে। 

The post ফোন ডেটা সংগ্রহের ফরেনসিক টুল যখন সাংবাদিক নিপীড়নের নতুন ক্ষেত্র   appeared first on Global Investigative Journalism Network.

Read Entire Article