সংঘাত সংশ্লিষ্ট যৌন সহিংসতা নিয়ে সাংবাদিকতার উত্তম চর্চা

1 year ago 48

English

যৌন সহিংসতা একটি জটিল ও সামাজিক ট্যাবু যা সাংবাদিকেরা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারেন না। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় বিষয়টিকে ধরতে পারা, সোর্সকে নিরাপত্তা দেওয়া এবং নৈতিকতার সঙ্গে রিপোর্ট করা বেশ কঠিন। সিরিয়া ও সাবেক যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধের মতো ইউক্রেনে চলমান রুশ আগ্রাসনে যৌন সহিংসতা বারবার সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এমন ঘটনা রিপোর্ট করবেন কী করে?

উত্তম চর্চাগুলো জানাতে জিআইজেএন সম্প্রতি সংঘাত সংশ্লিষ্ট যৌন সহিংসতা (সিআরএসভি) বিষয়ক অনুসন্ধান ও প্রতিবেদন নিয়ে একটি ওয়েবিনার আয়োজন করেছে। গত বছর ৩রা নভেম্বর, এই কঠিন বিষয়ের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন অ্যালিক্স ভুইলেমিন, লরেন উলফ ও গ্যাভিন রিস।

সেক্সুয়াল অথবা সেক্সুয়ালাইজড সহিংসতা সনাক্তকরণ

প্রথমেই, পরিভাষা নিয়ে একটি নোট। নিপীড়কের অভিপ্রায়কে যথাযথভাবে বোঝাতে ইদানিং সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের পরিবর্তে  “সেক্সুয়ালাইজড ভায়োলেন্স” পরিভাষাটি বেশি ব্যবহার করছেন বিশেষজ্ঞরা। এধরনের সহিংসতায় যৌন তৃপ্তির চেয়ে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের চর্চা বেশি করা হয়। কেউ কেউ একটি বোঝাতে গিয়ে আরেকটিও ব্যবহার করে থাকেন।

যুদ্ধ ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে এই অপরাধগুলো কীভাবে সামনে আসে, সেই মৌলিক নীতিগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন উইমেন ইনিশিয়েটিভস ফর জেন্ডার জাস্টিস-এর জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেসি উপদেষ্টা অ্যালিক্স ভুইলেমিন

তিনি বলেন, “যেখানেই যুদ্ধ, সেখানেই যৌন সহিংসতা থাকবে, সবসময়।”

এ ধরনের সহিংসতাকে “ইচ্ছাকৃত, সম্মতিবিহীন এবং যৌন সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড বলা হয় যা বয়স, লিঙ্গ বা জেন্ডার নির্বিশেষে যে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘাতের সময় বা সংঘাত সংশ্লিষ্ট কারণে সংঘটিত হয় বা ঘটে থাকে।” 

আরও পড়ুন যৌন সহিংসতা বিষয়ক হেগ নীতিমালা নিয়ে।

ভুইলেমিন সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে সেক্সুয়ালাইজড সহিংসতা এবং ধর্ষণ এক বিষয় নয়। যৌনাঙ্গ কর্তন, বলপূর্বক নগ্নতা, অন্তরঙ্গ ছবি ধারণ করা বা ছড়ানো, লিঙ্গ পরিচয় আড়াল করতে বিশেষ পোশাক পরতে বাধ্য করার মতো যৌন অবমাননা, এবং যৌন হয়রানি হলো উদ্দেশ্যমূলক যৌন সহিংসতার উদাহরণ।

ভুইলেমিন উদ্দেশ্যমূলক যৌন সহিংসতার কিছু আগাম সংকেতের কথা বলেছেন। গুম, উচ্ছেদ, বাড়িঘরে অভিযান, মারণাস্ত্র ও ক্ষুদ্র অস্ত্রের বিস্তার, ক্যাম্প ও চেকপয়েন্টে ধরপাকড়, জয় বা পরাজয়ের পর সৈন্যদের গতিবিধি ও লুটপাট – সবই কোনো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে উদ্দেশ্যমূলক যৌন সহিংসতার “সতর্ক সংকেত।”

যৌন সহিংসতা বিষয়ক হেগ নীতিমালা সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানা উচিত। এই নীতিমালা বেঁচে ফেরাদের ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী, সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগে সহায়ক একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো।

ভুইলেমিন বলেন, কোনো কিছুর ধরন যৌন কিনা, তা চিহ্নিত করার মূল বিষয় হলো সে বিষয়ে অপরাধী, ভুক্তভোগী বা তাদের ‍নিজ জনগোষ্ঠীর ধারণা।

অনেক সময় যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে সেক্সুয়ালাইজড সহিংসতার ব্যবহার হয়ে থাকে, কারণ গোটা জনগোষ্ঠীই এর শিকার হয়। সাংবাদিকদের মনে রাখতে হবে যে রক্ষণশীল সংস্কৃতিতে একজন নারী যৌন সহিংসতার শিকার হলে গোটা পরিবার ও সমাজ প্রভাবিত হয়।

‘কোন ক্ষতি নয়’ নীতি ও ট্রমা সচেতন সাক্ষাৎকারের কৌশল

নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক অভিজ্ঞ সাংবাদিক লরেন উলফ বলেছেন, গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর যৌন সহিংসতার প্রভাব পড়ে, তাই বেঁচে ফেরাদের পরিচয় আড়াল করতে অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি।

সেক্সুয়ালাইজড সহিংসতার বিশদ বিবরণ নিশ্চিত করতে গিয়ে ভুক্তভোগীরা যেন ফের মানসিক আঘাতের শিকার না হন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।

এই বিষয়গুলো নিয়ে সাংবাদিকতার নির্মম বাস্তবতা মনে করিয়ে তিনি বলেন, “আপনি কি কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবেন নাকি ছদ্মনামে স্টোরি করবেন?” 

উলফ সেক্সুয়ালাইজড সহিংসতার ভুক্তভোগীদের নিয়ে কাজ করার সময় সংবেদনশীলতা ও বিচক্ষণতার গুরুত্ব তুলে ধরেন। শরণার্থী শিবিরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি না করে বরং ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করা স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা খুঁজে বের করুন এবং কথা বলতে আগ্রহী, এমন কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বলুন। একবার কোনো সোর্সের সন্ধান পেলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, এমনকি পরিচয় প্রকাশে সম্মতি দিলেও তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সজাগ থাকুন। যেমন; পুলিশ বা সরকারের ডিজিটাল নজরদারির ঝুঁকি থাকলে সোর্সের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবেন না।

উলফ বলেছেন, প্রকৃত সাক্ষাৎকারে বেঁচে ফেরাদেরকে কথোপকথন এগিয়ে নিতে দিন। সেক্সুয়ালাইজড সহিংসতার বিশদ বিবরণ নিশ্চিত করতে গিয়ে ভুক্তভোগীরা যেন ফের মানসিক আঘাতের শিকার না হন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। সাক্ষাৎকারে এই ভুলগুলো এড়াতে ডার্ট সেন্টার ফর জার্নালিজম অ্যান্ড ট্রমা-এর উলফ ও গ্যাভিন রিসের দেওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ এখানে তুলে ধরা হলো:

  • তাড়াহুড়ো করবেন না। সাক্ষাৎকারদাতাকেই কথোপকথনের গতি ঠিক করতে দিন। তাড়াহুড়ো না করে সাক্ষাৎকারে যথাযথ সময় ও মনোযোগ দিন।
  • “কেন” প্রশ্ন এড়িয়ে চলুন। পুলিশি জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদে “কেন” প্রশ্ন ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায় – ভুক্তভোগীদের জন্য যা বিরক্তিকর হতে পারে।
  • সহিংসতার বর্ণনা বা অপ্রীতিকর তথ্য জিজ্ঞাসা করবেন না। সাধারণত স্টোরির জন্য এ ধরনের বর্ণনার প্রয়োজন পড়ে না। এই চর্চা ঘটনাকে চটকদার করে তুলতে পারে এবং জোরাজুরি করে ভুক্তভোগীদের সেই ঘটনা স্মরণের দিকে ঠেলে দিলে তাদের আরও ক্ষতি হতে পারে।
  • সম্মতি পর্যালোচনা ও ব্যাখ্যা করুন। আপনি যার সঙ্গেই কথা বলুন না কেন তিনি যেন জানেন কোন পাঠকশ্রেণী এই স্টোরি পড়বেন; এটি মুদ্রিত (সীমিত সংখ্যক পাঠক) নাকি ডিজিটাল (বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাবে) হবে, তা ঠিক করতে হবে। রিপোর্টিং বা সাংবাদিকতার চর্চা সম্পর্কে তারা জানেন, এমনটি ধরে নিবেন না।
  • প্রেক্ষাপট জেনে নিন। সেক্সুয়ালাইজড সহিংসতা যুদ্ধের একটি হাতিয়ার। “সৈনিক কী পরেছিল?” এবং “তারা কী বলেছিল?” এ ধরনের প্রশ্ন থেকে জানা সহজ হয় যে হামলাগুলো ব্যক্তিগতভাবে করা হয়েছে নাকি উপরের মহলের নির্দেশে হয়েছে।
  • চিকিৎসা ও সহায়তা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলুন। ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার ও মনোচিকিৎসকেরা আপনাকে হামলার আশেপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেন (যেমন; যেখানে আক্রান্তদের পাওয়া গেছে, হামলার আগে সৈন্যরা উপস্থিত ছিল কিনা, বা আদৌ হামলা হয়েছিল কিনা)।
  • রুল অব থার্ড মেনে চলুন। সোর্সের কাছে প্রথমেই জানতে চান যে তারা কখন নিরাপদ ও সুস্থ বোধ করেছে, তারপর সহিংসতার সময় সম্পর্কে এবং তারপর বর্তমান দিয়ে শেষ করুন- এখন তারা কী করছে, কীভাবে করছে। এর ফলে সাক্ষাৎকারের শেষে ভুক্তভোগীদেরকে মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয় না। সাক্ষাৎকারের শেষ অংশের জন্য আরও সময় রাখুন।

এখানে সংঘাত সংশ্লিষ্ট যৌন সহিংসতা নিয়ে কাজের উত্তম চর্চা আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে ডার্ট সেন্টার ইউরোপ।

মানসিক বিপর্যয় যেভাবে স্মৃতি ও সাক্ষ্যকে প্রভাবিত করে

সাংবাদিকেরা প্রায়ই সোর্সের খোঁজ, ব্রেকিং নিউজ স্টোরি জমা দেওয়া এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে ছবি ও ভিডিও ধারণ নিয়ে চাপে থাকেন। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে যৌন সহিংসতা নিয়ে প্রতিবেদনের সময় তা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

Young depressed woman, sexual trauma, war crimes. human trafficking, human rights violations.

যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের শরীরে আঘাতের সময় যা ঘটে তার ফলস্বরূপ তাদের স্মৃতি খণ্ডিত বা নন-লিনিয়ার থাকতে পারে। ছবি: শাটারস্টক।

রিস বলেছেন, মানসিক বিপর্যয়ের যে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক মাত্রা রয়েছে, তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকদের জন্য বিষয়গুলো নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে কিছুটা প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হতে পারে। মানসিক বিপর্যয়ের কারণে শারীরিক প্রভাবে ভুক্তভোগীদের স্মৃতি খণ্ডিত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। তাদের গল্পে ফাঁকফোকর থাকতে পারে।

রিস জোর দিয়ে বলেছেন, সোর্সের সাক্ষাৎকার নেওয়া ও স্টোরির সমর্থনে প্রয়োজনীয় প্রমাণ জোগাড়ের সময় উল্লিখিত পরামর্শের ব্যবহার, ঘাটতি পূরণে সহায়ক হতে পারে।

রিস বলেছেন, “এই ঘটনা সম্পর্কে আপনি কী জানাতে পারেন…” -এই ধরনের প্রশ্নগুলো তারা যে বিষয়ে কথা বলতে নিরাপদ বোধ করে, তা নিয়ে স্বেচ্ছায় তথ্য দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।”

কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে কথা বলার অবস্থায় তিনি আছেন কিনা তা জানতে চেয়ে বারবার অনুমতি নিলে বিনয়ের সঙ্গে অনুসন্ধানের সূত্র ধরিয়ে দেওয়া যায় এবং ভুক্তভোগীকে উত্তর দিতে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি এড়ানো যায়। রিস আরও বলেন, মানুষকে তাদের জটিল পরিস্থিতিতে দেখানোটা বেশ কঠিন। “ক্ষতিগ্রস্ত” ও “বিধ্বস্ত” জাতীয় শব্দ এড়িয়ে চলুন। কারণ এ ধরনের শব্দ সবসময় ক্ষতি ডেকে আনে।

পরিশেষে, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে রিপোর্ট করতে গিয়ে অনেক সময় রিপোর্টাররা নিজেরাই কীভাবে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হন, রিস তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, যৌন সংশ্লিষ্ট মানসিক বিপর্যয়ে সাক্ষ্য দেওয়া ও এগুলো শুনতে বিরক্ত লাগে, তাই আপনার নিজের সংবেদনশীলতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এ ধরনের রিপোর্টিংয়ের প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা জরুরি। অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখানো, সাক্ষাৎকারদাতাকে অতিমাত্রায় ‍প্রদর্শন করা এবং সাংবাদিক-সোর্স সম্পর্কের সীমারেখা লঙ্ঘন এড়াতে সহায়তা চাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের ১৫টি পরামর্শ

ইনভেস্টিগেটিং সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ: রিপোর্টিং টিপস অ্যান্ড টুলস

লেসনস লার্নড ফ্রম সিরিয়ান জার্নালিস্টস ইনভেস্টিগেটিং রাশিয়ান ওয়ার ক্রাইমস


Katarina Sabados portrait

ক্যাটারিনা সাবাদোস  কানাডার ভ্যাঙ্কুভার-ভিত্তিক মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক। তিনি বর্তমানে গ্লোবাল রিপোর্টিং সেন্টারে সাপ্লাই চেইন নিয়ে সংবাদ করছেন। তাঁর রিপোর্টিং ও গবেষণা এনবিসি নিউজ, কানাডার ন্যাশনাল অবজারভার, দ্য টাই, দ্য টরন্টো স্টার এবং ওসিসিআরপি-তে প্রকাশিত হয়েছে।

The post সংঘাত সংশ্লিষ্ট যৌন সহিংসতা নিয়ে সাংবাদিকতার উত্তম চর্চা appeared first on Global Investigative Journalism Network.

Read Entire Article