আর্ন্তজাতিক অলাভজনক ও বেসরকারি সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর বৈশ্বিক মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমাগত নিম্নগামী এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০২২ সালের পতন ছিল সবচেয়ে বড়। সূচকের প্রায় তলানিতে অবস্থান করা দেশটির অবস্থান এখন ১৬২ তম। এই সূচকে পাঁচটি বিভাগে সম্মিলিত পারফরম্যান্সের বিচারে দেশগুলোর র্যাঙ্কিং করা হয়: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনি কাঠামো, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং নিরাপত্তা।
এই সবগুলো বিভাগের মধ্যে শেষটিতে বাংলাদেশের স্কোর সর্বনিম্ন। আরএসএফের বিশ্লেষকদের দেশভিত্তিক সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় উঠে এসেছে, “পুলিশি সহিংসতা, রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা ও জিহাদি বা অপরাধী চক্রের সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বিচারের আওতায় না আসায় বাংলাদেশি সাংবাদিকেরা আরও বেশি ঝুঁকিতে আছেন।”
এসব প্রতিকূলতার কারণে দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়লেও রিপোর্টারেরা দুর্নীতি, অপরাধ ও পদ্ধতিগত অবিচারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে গুরুতর অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০২২ সাল এর ব্যতিক্রম ছিল না।
এই তালিকায় বাংলাদেশি রিপোর্টার ও গণমাধ্যমের এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্টোরি তুলে ধরা হয়েছে। এখানে এমন প্রতিবেদনও আছে, যেখানে সন্দেহজনক কর্পোরেট বিষয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার অনুসন্ধানে উন্মুক্ত নথি ব্যবহার করা হয়েছে।
তালিকার অন্যান্য স্টোরিতে স্যাটেলাইটের ছবি থেকে পাওয়া ডেটা ব্যবহার করে সম্ভাব্য পরিবেশগত অপরাধ উন্মোচন করা হয়েছে বা সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জুতোর শুকতলি ক্ষয় করা রিপোর্টিং কৌশল কাজে লাগিয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রীয় সংস্থার ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে৷ এ বছর জাতীয় পুরস্কারজয়ী রিপোর্টসহ বেশ কিছু স্টোরি বিশেষ মনোযোগের দাবিদার হলেও আমরা এমন কয়েকটি স্টোরির তালিকা তৈরি করেছি, যেগুলোতে অনুসন্ধানী প্রয়াস, গভীরতা ও প্রভাব উঠে এসেছে, এবং সর্বোপরি, ক্ষমতাকে জবাবদিহি করতে জনস্বার্থে নিবেদিত সাংবাদিকদের সাহসিকতাও প্রকাশ পেয়েছে।
কম্বোডিয়ায় সাইবার ক্রীতদাস
কম্বোডিয়ায় তাদের কাজ ছিল ফেসবুকে ছদ্মনামের নারী প্রোফাইল তৈরি করা, বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করা এবং তাদেরকে নির্দিষ্ট বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মে ১০০ মার্কিন ডলার বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা। এই অপকর্মের ক্রীড়নকদের নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে, প্রতিবেদনটি নতুন একদল ভুক্তভোগীদের সন্ধান দিয়েছে। তারা হলেন অভিবাসী শ্রমিক, যাদের অপরাধী চক্রের কাছে বিক্রি করা হয় এবং গ্রাহক না পেলে তারা কোনো টাকা পাবে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) এর এই স্টোরিতে উঠে আসে, দালালদের দেওয়া ভদ্রস্থ “ডেস্ক জব” এর প্রলোভনে পড়ে কম্বোডিয়ায় এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি এ ধরনের সাইবার দাসত্বের শিকার হয়েছেন, যাদেরকে পরবর্তীতে অপরাধী চক্রের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। তাদের কেউ বাড়ি ফিরে যেতে চাইলে বলা হত, যে দামে বিক্রি করা হয়েছে সেই ৩,৬০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে, অন্যথায় অন্য কোনো পক্ষের কাছে ফের বিক্রি করে দেয়া হবে।
টিবিএস দল কম্বোডিয়ায় আটকে পড়া বেশ ক’জন বাংলাদেশিকে সনাক্ত করেছে এবং ফেরত আসা প্রায় এক ডজন অভিবাসীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। রিপোর্টারেরা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পাননি। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করে তাঁরা জানতে পারেন যে আসলে এ ধরনের শোষণকে ঘিরে বেশ কিছু ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে: একটি দূতাবাসের কর্মকর্তারা এই ভুক্তভোগীদের যথাযথ ওয়ার্ক-পারমিট নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদেরকে “অবৈধ অভিবাসী” বলে অভিহিত করেছেন।
ভুয়া ডাক্তারের কারখানা
আপনি কি দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও কঠিন পরীক্ষার ঝক্কি ছাড়াই ডাক্তার হতে চান? পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে যদি রাতারাতিই সার্টিফিকেট পাওয়ার উপায় থাকে? অথবা পাঁচগুণ অর্থের বিনিময়ে যদি আরও মূল্যবান বিদেশি সার্টিফিকেট মেলে? ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রতিবেদক ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারির (এমবিবিএস) এমন একটি সার্টিফিকেট হাতে পেতে ছদ্মবেশ ধরেছিলেন। তিনি নিজের নামে ডাক্তারের বিজনেস কার্ড ছাপিয়েছেন, ডাক্তারি চর্চার জন্য একটি চেম্বার ভাড়া নিয়েছেন, চেম্বারের বাইরে ডাক্তারের পরিচয় সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন এবং প্রকৃত রোগীকে ডাক্তারি পরামর্শ দেওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ করেছেন।
এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে মেডিকেল ডাক্তার নিবন্ধন ব্যবস্থায় প্রতারণা করা কতটা সহজ। এটি আক্ষরিক অর্থে দুটি টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার নিয়ে এক কক্ষ সর্বস্ব একটি ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছে, যেখানে মেডিসিন ও সার্জারিতে পেশাদার ডিগ্রির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জাতীয় সার্টিফিকেট বিক্রি হয় মাত্র ৫ লাখ টাকায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দেশে ছয় হাজারেরও বেশি ভুয়া চিকিৎসক রয়েছে, এমনকি এই স্টোরিতে ভুয়া চিকিৎসকদের চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের নির্দেশনা দিতেও দেখা যায়। এমন একজন চিকিৎসকের কাছে এমবিবিএস এর পুরো অর্থ জানতে চাইলে বলতে পারেননি। প্রতিবেদনে, দেশের মেডিকেল পেশা চর্চার স্বীকৃতিদানকারী কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে যে অতীতে তাদের সার্টিফিকেশন ব্যবস্থার অপব্যবহার হয়েছে।
একটি পরিবারের অন্তহীন ভোগান্তি
গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তাদের বিরুদ্ধে শত শত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। দ্য ডেইলি স্টারের রিপোর্ট, র্যাবের হাতে ভোগান্তির শিকার হওয়া একটি পরিবারের গল্পকে তুলে এনেছে। পরিবারটির ভাষ্যমতে, তাদের বড় ছেলে চার বছর আগে নিখোঁজ হয় এবং সাদা পোশাকে র্যাবের একটি দল তাকে অপহরণ করে বলে জানায়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলে বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের যে ৭৬টি ঘটনা তালিকাভুক্ত করেছে এটি তার একটি। দলটি ঘটনাগুলো নিয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। কথিত একই র্যাব ইউনিট এ বছর নিখোঁজ ব্যক্তির ছোট ভাইকে, আগেই খারিজ হয়ে যাওয়া একটি মাদক মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। দুই রিপোর্টার এমন আরও একটি ঘটনার সন্ধান পানে যেখানে একই পরিবারের ১৫ বছর বয়সী একজন ও ১৭ বছর বয়সী একজনকে চাঁদাবাজির একটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। কোন ইউনিট দায়ী? সেই র্যাব।
এই অনুসন্ধানে সিসিটিভি ফুটেজ, নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের দেওয়া কল রেকর্ড এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সোর্সের সাক্ষাৎকার ব্যবহার করা হয়েছে, এবং র্যাবের ঐ ইউনিটের একজন কমান্ডিং অফিসার বলেছেন, “সব অভিযোগ তদন্ত করা হবে।”
বালু, জমি এবং ক্ষমতা
দক্ষিণ এশিয়ায় বালু উত্তোলন একটি বড় ব্যবসা। দৈনিক প্রথম আলোর এই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি জলপথে কীভাবে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হচ্ছে।
প্রতিবেদক প্রথমে রাজধানী ঢাকার দক্ষিণে চাঁদপুরের কাছে একটি স্পিডবোট থেকে বালু উত্তোলনের পরিমাণ হিসাব করেন। বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তীর ধসে পড়ছে ও মাছের পোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এমন সতর্কতার পরও তিনি ৬৭টি ড্রেজার সক্রিয় অবস্থায় দেখতে পান। শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০ টিরও বেশি ড্রেজার দিয়ে পদ্মা-মেঘনা মোহনার বিভিন্ন অংশ থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এখানে ২৪ঘণ্টা বালু উত্তোলনের ফলে চাঁদপুর থেকে প্রতি বছর প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ঘনফুট বালু উত্তোলিত হয়। পত্রিকাটির দেয়া তথ্য মতে, এই কার্যক্রমের আর্থিক সুবিধাভোগী হল একজন স্থানীয় চেয়ারম্যান, যিনি গত আট বছরে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সম্পদ গড়েছেন, যদিও স্থানীয় প্রশাসন বার বার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে বেপরোয়া ড্রেজিং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
অনুসন্ধানে, পত্রিকাটির ভাষায়, “বালু খেকো” চেয়ারম্যানের সঙ্গে সরকারের এক মন্ত্রীর কথিত যোগসাজস উঠে এসেছে। মন্ত্রী এই সম্পর্ক অস্বীকার করেননি, তবে তাঁর চিঠিতে, প্রকল্পটিকে “জনস্বার্থ” সংশ্লিষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে সেই চেয়ারম্যান কোনো ধরনের অপকর্মের কথা নাকচ করেছেন। প্রাথমিক প্রমাণের পাশাপাশি এই অনুসন্ধানে কার্যক্রমটির সঙ্গে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার পক্ষে অনেকগুলো সরকারি নথি জোগাড় করা হয়েছে এবং সেই তথ্যকে একাধিক সূত্র দিয়ে যাচাই করা হয়েছে।
৮৩,০০০ কারাবন্দী, চার ডাক্তার
দৈনিক প্রথম আলোর এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের কারাগারে স্বাস্থ্যসেবার ভয়াবহ বাস্তবতা প্রকাশ্যে এনেছে। ৬৮টি কারাগারে ৮৩,০০০ জনের বেশি বন্দীর চিকিৎসার জন্য আছে মাত্র চারজন ডাক্তার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একমাত্র কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ জন রোগী দেখেন, আর সেখানে না আছে কোনো পরীক্ষাগার, না আছে পরীক্ষা নিরীক্ষার সরঞ্জাম। চট্টগ্রামের আরেকটি কারাগারেও ডাক্তার একইভাবে প্রতিদিন ২৫০ জন রোগী দেখেন। প্রতিবেদন করতে গিয়ে দেখা যায়, কারা-চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দ ১৪১টি পদের ১৩৭টিই শূন্য রয়েছে।
পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম এই প্রতিবেদনের জন্য ১০টি কারাগারে সন্ধান চালিয়েছেন। দেখতে পেয়েছেন যে সেখানে প্রায় ৩,০০০ নারী বন্দী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অথবা মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন বা পরামর্শের জন্য কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বিপুল সংখ্যক বন্দীর হৃদরোগ, কিডনি ও যকৃতের রোগ আছে এবং কেউ কেউ ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা বা এইডসের মত রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশের কারাগারে চিকিৎসা সংকট নিয়ে বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় গণমাধ্যমে রিপোর্ট হলেও এই অনুসন্ধান প্রকাশের পর উচ্চ আদালত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সব কারাগারে চিকিৎসক নিয়োগের নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে, বন্দীদের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে বলেও রুল জারি করেন।
একটি জ্বালানি চুক্তি ঘিরে কঠিন যত প্রশ্ন
বাংলাদেশের প্রথম ভাসমান তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল ২০১৯ সালে চালু করা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজি সংরক্ষণ করা এবং পরবর্তীতে তা দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করার কথা। উপকূলীয় মহেশখালীতে অবস্থিত এই টার্মিনাল তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করবে বলে আশা করা হয়। জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক সমকাল এই প্রতিশ্রুতিগুলো যাচাই করতে গিয়ে অর্থের গতিপথ অনুসরণ করেছে এবং গোপন কর্পোরেট মালিকানা, সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন ও সরকারি পক্ষপাতিত্বের একটি জটিল জাল খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছে। রিপোর্টারদের দাবি অনুসারে, টার্মিনাল পরিচালনাকারী কোম্পানিটি কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই কাজটি পেয়েছে, আর কোম্পানিটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যারে নিবন্ধিত দুটি মার্কিন সংস্থার মালিকানাধীন, যাদের প্রকৃত মালিকানা লুকোনো গোপনীয়তার আড়ালে। দৈনিক সমকালের অনুসন্ধানটি আরও জানিয়েছে, প্রকল্পটির প্রকৃত আমদানিকৃত পণ্য ও আমদানি ব্যয়ের হিসেবে বহু-মিলিয়ন ডলারের তারতম্য রয়েছে এবং এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযোগের জবাবে কোম্পানিটি বলেছে, পরামর্শ সেবা ও যন্ত্রপাতি সংযোজন পরিষেবার জন্য একটি ফরাসি প্রতিষ্ঠানকে কয়েক মিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে।
সংরক্ষিত বনে চা বাগান
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একটি আধা-চিরহরিৎ সুরক্ষিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় বন। গুরুতর বিপন্ন প্রজাতির বানর এবং ৩০০ টিরও বেশি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, উভচর ও সরীসৃপের আবাসস্থল এই বন জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতেও ভূমিকা রাখে। যমুনা টিভির এই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, চা বাগান করে, গাছ লাগিয়ে বাগান গড়ে, এমনকি রিসোর্ট তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্য সহ রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কীভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি দখলে জড়িত ছিলেন।
যদিও সংসদ সদস্য দাবি করেছেন যে তারা বৈধভাবে চা বাগানের জমি পেয়েছেন, কিন্তু এই প্রতিবেদক স্থানীয় ভূমি অফিসের সঙ্গে কথা বলে এবং গুগল আর্থে চার বছরের ছবি তুলনা করে দেখিয়েছেন যে প্রশ্নবিদ্ধ চা বাগানটির আয়তন দাবি করা সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। প্রকৃত অবস্থা উন্মোচনের জন্য তিনি একজন রিসোর্ট নির্মাতার ছদ্মবেশে বনে যান এবং আরেকটি দলের খোঁজ পান। এই দলটি তাঁকে বনভূমির দখল করা অংশ ঘুরিয়ে দেখায় এবং তারা সেটি বিক্রির চেষ্টা করছে বলে জানায়। স্থানীয় বন কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদককে বলেছেন যে তারা জমি দখলের বিষয়টি অবগত নন, আর বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবেন।
মগজ নিয়ে খেলা
স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি হারুনুর রশিদ দীর্ঘদিন ধরেই বিচিত্র দাবি করে আসছিলেন যে অন্য কেউ তার মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করছে। মস্তিষ্ক হ্যাক করার অভিযোগে তিনি নিজের শ্যালিকা ও তার বন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা নিতে স্থানীয় পুলিশকে রাজিও করিয়েছিলেন। চ্যানেল ২৪-এর সার্চলাইট দলের অনুসন্ধানের আগে তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে সহানুভূতিমূলক প্রতিবেদনও ছাপিয়েছেন। তার আরও কিছু অযৌক্তিক দাবি: তার মস্তিষ্ক একটি মাইক্রোচিপ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে (প্রমাণ হিসেবে তিনি মাথার এমআরআই স্ক্যান দেখান); একটি ফ্রিকোয়েন্সি স্ক্যানার তার মাথার কাছে নিলে বিপ করে; আর কেউ বারবার তার মস্তিষ্ক থেকে পাসওয়ার্ড চুরি করে তার ইমেইল ও ফোন হ্যাক করেছে।
সার্চলাইট এক এক করে এই দাবিগুলোকে খণ্ডন করেছে। দলটি এমআরআই স্ক্যানের রিপোর্ট মেলাতে হাসপাতালে যায় এবং দেখা যায়, রশিদ যে রিপোর্ট সামনে এনেছে তা জালিয়াতি করে তৈরি করা। আর ফ্রিকোয়েন্সি স্ক্যানার? এটি একটি সস্তা যন্ত্র যা রিপোর্টার নিজের ও অন্যদের মাথার আশেপাশে নিলেও ‘বিপ’ শব্দ করে। যে বিশেষজ্ঞেরা রশিদের চুরি হওয়া পাসওয়ার্ড ও অনলাইন অ্যাকাউন্টগুলো পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছেন বলে দাবি করা হয়, অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, তারা জাল টুইটার অ্যাকাউন্ট ও প্রোফাইল ছবি দিয়ে বানানো ভুয়া চরিত্র। রশিদের গল্প নিয়ে এই অনুসন্ধান বেশ আলোচিত হয়। সার্চলাইটের এই পর্ব ইউটিউবে ১৬ লাখেরও বেশিবার দেখা হয়েছে।
আরও পড়ুন
এডিটর’স পিক: ২০২০’জ বেস্ট ইনভেস্টিগেটিভ স্টোরিজ ইন ইন্ডিয়া
অর্গানাইজড ক্রাইম ইন দ্য গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল
সম্পাদকের বাছাই: ২০২১ সালে বাংলাদেশের সেরা অনুসন্ধান
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, জিআইজেএন-এর বাংলা ভাষার সম্পাদক। তিনি জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন, গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা, এমআরডিআই-এর কর্মসূচি ও যোগাযোগ প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতায় তাঁর রয়েছে ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা, যার বড় অংশই সম্প্রচার মাধ্যমে।
The post ২০২২ সালে বাংলাদেশের সেরা অনুসন্ধান appeared first on Global Investigative Journalism Network.